গৌরবের জাতীয় সংসদ এক ঐতিহাসিক কাব্য
আল্লামা ইকবাল অনিক | ১২:৩১ মিঃ, জুলাই ১৯, ২০১৮
জাতীয় সংসদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ আইনসভা। এককক্ষ বিশিষ্ট এই আইনসভার সদস্য সংখ্যা ৩৫০ জন। ৩০০ জন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন আর বাকি ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। ১৯৮২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অধিবেশনের মধ্য দিয়ে এই ভবনের উদ্বোধন হয়।
জাতীয় সংসদ ভবন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রধান ভবন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আইনসভার জন্য এই ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শুরুর ২১ বছর পর ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। আর জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা প্রণয়ন করেন প্রখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই আই কান। মাহফুজ চৌধুরী ছিলেন সহকারী স্থপতি। লুই আই কান তার স্থাপত্যশৈলীতে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন এই ভবনের নকশায়। মূল ভবনটি পৃথক ৯টি ব্লকে ২০০ একর এলাকার উপর অবস্থিত। এই ভবনের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১২৯ কোটি টাকা।
ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু হয় নির্বাচন ব্যবস্থা। ঐ সময়ে শাসকেরা নির্বাচিত স্থানীয় সরকার সংস্থা; যেমন গ্রামপ্রধান, পঞ্চায়েত, পাটোয়ারী, আমীন, মুনসেফ, থানাদার ও কাজীর পদসমূহ বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাচীন নির্বাচন ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে। এসব প্রতিষ্ঠান জনসমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তখনও সর্বজনীন না হলেও সেখানে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়েছিল। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ২৫০ সদস্যের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি গঠিত হয়। ৭ এপ্রিল ১৯৩৭ সালে কোলকাতায় শুরু হয় প্রথম অধিবেশন। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি স্পিকার ছিলেন এম আশরাফ আলী।
১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ এপ্রিল ফেব্রæয়ারি কোলকাতার বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি প্রথম অধিবেশেন শুরু হয়। এই সংসদে স্পিকার নুরুল আমিন এবং ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট তোফায়েল আলী নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর হিন্দুদের ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ, জমিদারি প্রথার বিলোপ এবং ১৯৫৬ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান প্রবর্তনের ফলে বিভাগপূর্ব নির্বাচন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ ও জেলা বোর্ড নির্বাচনে তুলনামূলকভাবে নবীন ও অনাবাসিক আইনজীবীরা প্রাধ্যন্য পায়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৫ মে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ১৯৫৪ সালের ৩১ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করে দিয়ে শাসনতন্ত্রের ৯২ (ক) ধারা জারীর মাধ্যমে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করেন। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জন্য সম্ভাবনার সৃষ্টি হলেও বানোয়াট অভিযোগে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভাকে বাতিল করার পাশাপাশি ৯২-ক ধারার আড়ালে বিশেষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতাকে গ্রেফতার করেছিল সরকার। দলের সভাপতি মওলানা ভাসানীকে প্রকাশ্যে গুলী করে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন গভর্ণর ইস্কান্দার মির্জা। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেয়ার কারণে মওলানা ভাসানী সে সময় দেশে ছিলেন না। তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে করাচি কেন্দ্র্রিক ক্ষমতাসীন চক্র ও ষড়যন্ত্রকারীরা সাফল্যের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ‘শেরে বাংলা’ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তার ফলে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন ঘটে। উল্লেখ্য, কোলকাতা থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্টের ঐক্য টিকিয়ে রাখার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব অনমনীয় থাকায় যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গিয়েছিল।
যুক্তফ্রন্টের এই ভাঙনে দলগতভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর কারণ, ৯২-ক ধারা প্রত্যাহারের পর ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় গঠিত মন্ত্রিসভা ‘যুক্তফ্রন্ট’ নাম নিয়েই শপথ নিয়েছিল। অর্থাৎ যুক্তফ্রন্ট সরকারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক আওয়ামী মুসলিম লীগ এতে সুযোগ পায়নি। এরই পাশাপাশি দলত্যাগ করেছিলেন আওয়ামী লীগের ৩৯ জন সদস্য, যার ফলে দলটির পরিষদ সদস্য সংখ্যা কমে হয়েছিল ১০৪। ওদিকে গণপরিষদের ৩১টি মুসলিম আসনের নির্বাচনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ পেয়েছিল ১৬টি। বড় দল হলেও আওয়ামী লীগের ভাগে এসেছিল মাত্র ১২টি আসন। পরবর্তীকালে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে একটি আসন পাওয়ায় দলটির সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৩।
ষাট ও সত্তরের দশকে এ প্রক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটে। তখন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে পেশাদার রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিরক্ষাসহ র্সার্বিক ক্ষেত্রে যে শোষণ নির্যাতন ও বৈষম্য চলে আসছিল তা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানসহ তাঁর দোসররা ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবকে বন্দী করে এবং ছয় দফার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন শুরু করে।
এর মধ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি ও সামরিক বেসামরিক অন্য ৩৪ জনকে আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য) করে আইয়ুব সরকার। সরকার ভেবেছিল এই মামলার মাধ্যমে জনগণকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাবে।
কিন্তু জনগণ এই মামলাকে বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন দমানোর জন্য শেখ মুজিব ও অন্যদের ফাঁসানোর সরকারি ষড়যন্ত্র বলে মনে করে। ফলে ছয় দফার পক্ষে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চাঙা হয়ে ওঠে। কারাগার থেকে শেখ মুজিবের অনুরোধে তৎকালীন ন্যাপ নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অংশগ্রহণ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
ভাসানীসহ প্রগতিশীল ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন। ৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বিরোধী দলগুলোর ঢাকায় আহুত হরতালের সময় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হয়। ৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছয় দফার পাশাপাশি সম্পূরক হিসেবে ১১ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে এবং ছয় ও ১১ দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে।
এতে যুক্ত হয় শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০ জানুয়ারি ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেওয়া হাজারও ছাত্র-জনতার সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মুখোমুখি সংঘর্ষে অনেকে আহত হয়।
২৪ জানুয়ারি ছিল প্রতিবাদ দিবস। ওইদিন সচিবালয়ের এক নম্বর গেটে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শেখ রুস্তম আলী, মকবুল ও মতিউর রহমান নিহত হন। এ ছাড়া আরও কয়েক জায়গায় তিনজন নিহত ও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটলে আন্দোলন বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে ওঠে। এদিন ছাত্রজনতা বেশ কয়েকটি সরকারি অফিস, আন্দোলনবিরোধী ভুমিকা রাখা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিস, আগরতলা মামলার প্রধান বিচারক এস রহমানের বাসা ইত্যাদিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এভাবে দিনটি গণ-অভ্যুত্থান দিবসে পরিণত হয়। গণ-আন্দোলনের দিনগুলোতে শ্লোগান উচ্চারিত হয় ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, জেলের তালা ভাঙব-শেখ মুজিবকে আনব’, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা-মানি না মানব না’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি।
১৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে বন্দী অবস্থায় আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা এবং সার্জেন্ট ফজলুল হককে আহত করা হলে ছাত্র-জনতা আরও ফুঁসে উঠে। পরদিন সামরিক বাহিনীর টহল ও জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে কড়া হরতাল পালন করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যার পর আন্দোলন এমন চরমে পৌঁছে যে, সরকার জনতার এ আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয় এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্তি দেয়। মুক্তি লাভের পর দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে এদেশের ছাত্রজনতার পক্ষে তোফায়েল আহমদ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
বস্তুত ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সোপান। এই আন্দোলন বাংলার সবস্তরের মানুষকে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানি শাসন শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করে এবং সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ ত্বরান্বিত করে। আইয়ুবের পর সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এলেও দাবি আদায়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের তীব্রতা উপলব্ধি করে তিনি সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সত্তরের নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।
গণ-আন্দোলন চলাকালে উচ্চারিত শ্লোগানগুলোই ছিল সত্তরের নির্বাচনের পূর্বাপর অর্থাৎ একাত্তরের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনের সময়কার বহুল উচ্চারিত ও গণজাগরণে প্রেরণাদায়ক সঞ্জীবনী বাণী। সর্বোপরি এই আন্দোলন বাঙালি ছাত্র-জনতাকে একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুপ্ত আকাঙ্খাকে উজ্জীবিত করেছিল।
এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বাংলার মানুষ তাদের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় প্রদান করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনেই বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এই নির্বাচন বাঙালিদের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সৃষ্টির লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ণের সুযোগ তৈরি করে এবং বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকার গঠনের অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তার ক্রীড়ণকেরা নানা তালবাহানা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করলে বাঙালিরা এক দফা অর্থাৎ চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের দিকে ধাবিত হয়।
সত্তরের নির্বাচনী রায় না মানার ফল হিসেবে আসে ঐতিহাসিক সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা,- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সংঘটিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। সারা দেশের (বাংলাদেশ) প্রশাসন, ব্যাংক, বিমা, ডাক ও তার বিভাগ, আদালত, বেতার-টেলিভিশন সবকিছুই চলে কেবল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। সঙ্গে চলতে থাকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান ভুটো গং বাঙালিদের চিরতরে দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা করে। ২৪ মার্চ সকাল থেকেই বঙ্গব্ধুর কাছে খবর আসতে থাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুরসহ বিভিন্নস্থানে পাক সেনারা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে। ২৫ মার্চ কালো রাতে শুরু হয় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর তা প্রতিরোধের মাধ্যমে চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য আসে বঙ্গবন্ধুর ডাক।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরষিদের ১৬৯ জন সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের ৩০০ জন সদস্যের সমন্বয়ে প্রভিশনাল কন্সস্টিটউিশন অব বাংলাদেশ অর্ডার ১৯৭২ এর অধীনে বাংলাদেশ গণ-পরিষদ গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭২ সালের গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। গণ-পরিষদের প্রথম স্পিকার নির্বাচিত হন শাহ আব্দুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার মুহম্মদুল্লাহ। স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদের মৃত্যুর পর স্পিকার নির্বাচিত হন মুহম্মদুল্লাহ ও ডেপুটি স্পিকার মো. বয়তুল্লাহ। গণ-পরিষদের উদ্যোগে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে গণমানুষের সংগ্রামী প্রচেষ্টায় নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার যে উত্তরাধিকার সৃষ্টি হয়েছিল- স্বাধীন বাংলাদেশে সেই সব ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ গণপরিষদ ধারণ করেছে। নিয়মতান্ত্রিক, আইনসিদ্ধ ও রাজনৈতিক বৈধতা প্রাপ্ত পূর্বেকার অর্জনগুলোর সযতœ, যথাযথ, ন্যায্য ও বৈধ প্রয়োগের নিমিত্তে ১৯৭২-এর জানয়ারির ১১ তারিখ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত “বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২” জারি করা হয়। এই আদেশ বলে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবলম্বিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অতঃপর একে একে “বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ, ১৯৭২” এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আইন জারি করে ১৯৭২- এর এপ্রিলের ১০ তারিখ- অর্থাৎ ১৯৭১-এ যেদিন গণপরিষদ ভূমিষ্ঠ হয়, সেদিনটিতেই স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। এটি গণপরিষদের দ্বিতীয়পর্র্বের যাত্রা। এ পর্বে পরিষদের সামনে কাজ ছিল মূলত একটি- আর তা হচ্ছে বাঙালির বহু যুগের চির কাঙ্খিত একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নন করা।
১৯৭২-এর এপ্রিলের ১১ তারিখ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে গঠিত হয় ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট “খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটি।” এই কমিটি একই বছরের এপ্রিলের ১৭ তারিখ প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনের শুভ সূচনা করে।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু:
৭ মার্চ ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশে ৩০০ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। এই সংসদের সংসদনেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মো. মনসুর আলী । আর এই সংসদের চিফ হুইফ ছিলেন শাহ মোজ্জামেল হোসেইন। প্রথম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ছিল ১৫টি। প্রথম জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন মুহম্মদুল্লাহ ও ডেপুটি স্পিকার মো. বয়তুল্লাহ। পরে মুহম্মদুল্লাহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আবদুল মালেক উকিল স্পিকার নির্বাচিত হন।
১৯৭৩ সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চ বার্ষিক উনয়ন পরিকল্পনায় কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো ও কুটির শিল্প উন্নয়নে প্রাগ্রাধিকারমূলক সরকারি অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থাকা স্বত্তে¡ও মুজিব ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাÐের মাধ্যমে ইসলামি অনুশাসনের পথে অগ্রসর হন। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে আঁতাতের অভিযোগে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক একাডেমি পুনরায় চালু করেন। ইসলামিক গোত্রগুলোর জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মদ তৈরি ও বিপণন এবং জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন। তাঁরই সিদ্ধান্তক্রমে বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স ও ইসলামিক ডেভেলপমেণ্ট ব্যাংক-এর সদস্যপদ গ্রহণ করে। মুজিব ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে যান যা পাকিস্তানের সাথে কিছুমাত্রায় সম্পর্ক উন্নয়ন ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি পেতে সহায়তা করে। জনসাধারণের সামনে উপস্থিতি ও ভাষণের সময় শেখ মুজিব ইসলামিক সম্ভাষণ ব্যবহার বাড়িয়ে দেন এবং ইসলামিক আর্দেশের উল্লেখ করতে থাকেন। শেষ বছরগুলোতে মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ “জয় বাংলা” অভিবাদনের বদলে ধার্মিক মুসলিমদের পছন্দনীয় “খোদা হাফেজ” বলতেন।
১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে যুদ্ধবিদ্ধস্ত নতুন দেশে বিদেশী ষড়যন্ত্রে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সংবিধান প্রথম সংশোধনী আইন ১৯৭৩ যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী আপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিরাক্রমনে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে “জরুরি অবস্থা” ঘোষণার বিধান রেখে ১৯৭৩ দ্বিতীয় সংশোধনী পাস হয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় বিধান তৃতীয় সংশোধনী ১৯৭৪ পাস হয়। সঙবিধানর সংসদীয় চতুর্থ সংশোধনী আইন-১৯৭৫ শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন এবং বাকশাল গঠন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আইন-১৯৭৯ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকে বৈধতা দান,"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" সংযোজন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর কিয়দংশ ষয়যন্ত্রে সংঘটিত অভ্যুত্থানে তিনি সপরিবারে নিহত হন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মুশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করে। সে নতুন করে মন্ত্রী সভা গঠন করে। তার কার্যকাল ছিল ১৫ই আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পযন্ত। এ সময় সামরিক আইন জারী করা হয়। তার কর্মকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব লাভ করেন বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মাদ সায়েম।
সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহি বিপ্লব নামের আন্দোলনের পর পর্যায়ক্রমে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মি স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয়। তিনি এসময়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমের পরে ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামের রাজনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৮ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতীয় গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামকরণ করা হয়। জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল।
১৮ ফেব্রæয়ারি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ছিলেন। নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৩০০ আসনের ২০৭ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান), জাসদ, মুসলিম লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), বাংলাদেশ জাতীয় লীগসহ আরও বেশ কয়কেটি দল অংশগ্রহণ করে। এই সংসদের সংসদ নেতা ছিলেন শাহ মো. আজিজুর রহমান। এই সংসদের চিফ হুইফ ছিলেন আবুল হাসানাত। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন আসাদুজ্জামান খান। এই সংসদে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ আসন থেকে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত প্রথম নারী সদস্য ছিলেন সৈয়দ রাজিয়া ফয়েজ। দ্বিতীয় এই সংসদে নারী সংরক্ষিত আসন ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়। এতে আসন বেড়ে হয় ৩৩০। ১৯৭৯ সালের ২ এপ্রিল থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় সংসদের প্রথম অধিবশেন। এই সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন মির্জা গোলাম হাফিজ এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ চৌধুরী। ১৯৮১ সালের ২৯ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। অত:পর উপ-রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কয়জন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পাকিস্তানে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন তাদের মধ্যে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ অন্যতম। বিচারপতি আবদুস সাত্তারের দুর্বল নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রক্তপাতবিহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।
৭ মে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে প্রায় ১৫শ’র বেশি প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। এই নির্বাচনে ১৫৩ আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি জয়লাভ করে। দ্বিতীয় সংসদের বিজয়ী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করে। এই সংসদের সংসদ নেতা নির্বাচিত হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। এই সংসদের চিফ হুইফ ছিলেন ডা. টিআইএম ফজলে রাব্বী চৌধুরী। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা। ১০ জুলাই ১৯৮৬ তারিখে তৃতীয় সংসদের প্রথম অধিবশেন। এই সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন সামসুল হুদা চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার এম কোরবান আলী।
সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন-১৯৮৬ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইন বলবৎ থাকাকালীন সময়ে প্রণীত সকল ফরমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, নির্দেশ ও অধ্যাদেশসহ অন্যান্য সকল আইন অনুমোদন।
৩ মার্চ ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। নির্বাচনটি বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান দলই বর্জন করেছিল; যেমন, আওয়ামী লীগ, জাতীয়াতাবাদী দল, জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মুজাফ্ফর) এবং ওয়ার্কার্স পার্টি। ৩৩০ আসনের মধ্যে ৩০০ জন সংসদ সদস্য ছিলেন। কারণ সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কোন নারী আসন ছিল না। এই সংসদের সংসদ নেতা নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও কাজী জাফর আহমেদ। এই সংসদের চিফ হুইফ ছিলেন এমএ আব্দুর সাত্তার। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন আ স ম আব্দুর রব। ১৯৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল চতুর্থ সংসদের প্রথম অধিবশেন। এই সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন সামসুল হুদা চেীধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ।
সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী আইন ১৯৮৮ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতিদান ও ঢাকার বাইরে ৬টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন। উধপপধ-এর নাম উযধশধ এবং ইধহমধষর -এর নাম ইধহমষধ -তে পরিবর্তন করা হয়। সংবিধানের নবম সংশোধনী আইন ১৯৮৯ রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের সাথে একই সময়ে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, রাষ্ট্রপতি পদে কোন ব্যক্তিকে পর পর দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ রাখা। সংবিধানের নবম সংশোধনী আইন ১৯৯০ রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে মহিলাদের ৩০টি আসন আরো ১০ বছরকালের জন্য সংরক্ষণ।
চতুর্থ জাতীয় সংসদে নারী সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় পঞ্চম সংসদে নারী সংরক্ষিত আসন সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়। পরে সংসদে পরোক্ষ ভোটে আসনে ৩০টি সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য নির্বাচিত হয়। এই সংসদের সংসদ নেতা নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। এই সংসদের চিফ হুইফ খন্দকার দেলওয়ার হোসেন। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা। এই সংসদে প্রথম স্পিকার নির্বাচিত হন আব্দুর রহমান বিশ্বাস এবং ডেপুটি স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী। আব্দুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী ও ডেপুটি স্পিকার হুমায়ুন খান পন্নী নির্বাচিত হন।
সংবিধানের একাদশ সংশোধনী আইন ১৯৯১ স্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বপদে ফিরে যাবার বিধান। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী আইন ১৯৯১ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রবর্তন ও উপ-রাষ্ট্রপতি পদ বিলুপ্তি।
১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ৩০০ আসনে জয় লাভ করে। এই নির্বাচনকে সব দলই বর্জন করে। এই সংসদের সংসদ নেতা নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। এই সংসদের চিফ হুইফ খন্দকার দেলওয়ার হোসেন। সব দল নির্বাচন বর্জন করায় এই সংসদে কোন বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন না। সংসদে শেখ রাজ্জাক আলী স্পিকার ও এল কে সিদ্দীকি ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
সংবিধানের এয়োদশ সংশোধনী আইন ১৯৯৬ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নিদর্লীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
১২ জুন ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ ৮১টি দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৪৬ আসন পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। আর এই সংসদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৩০। ১৯৯৬ সালের ১৮ জুলাই সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই সংসদের সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। এই সংসদের চিফ হুইফ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন খালেদা জিয়া। স্পিকার নির্বাচিত হন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর স্পিকার নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ এবং ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ।
১ অক্টোবর ২০০১ সাল অষ্টম জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে চালু হওয়া তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ ৫৪টি দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এই সময় নির্বাচনকালীন তত্বাবধায়ক প্রধান ছিলেন লতিফুর রহমান। এই নির্বাচনে ১৯৩টি আসন পেয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জয়লাভ করে। অষ্টম জাতীয় সংসদের অধিবশেন শুরু হয় ২৮ অক্টোবর। এই সংসদে মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০০ জন। কারণ নারী সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নারী আসন ছিল না। এই সংসদের সংসদ নেতা নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। এই সংসদের চিফ হুইফ খন্দকার দেলয়ার হোসেন। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা। সংসদে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার স্পিকার ও আখতার হামিদ সিদ্দীকি ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। অষ্টম সংসদ সংবিধান বিল-২০০৪ পাস করে। এই আইন দ্বারা নারী আসন ৩০ থেকে ৪৫ উন্নীতকরণ করা হয়। আর মেয়াদ ১০ বছর বাড়ানো হয়।
সংবিধান চতুর্দশ সংশোধনী আইন ২০০৪ নারীদের জন্য সংসদে ৪৫টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি সংরক্ষণ, অর্থ বিল, সংসদ সদস্যদের শপথ, সাংবিধানিক বিভিন্ন পদের বয়স বৃদ্ধি।
২৯ ডিসম্বের ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। নির্বাচনের আগে জরুরি অবস্থা তুলে নেয় তৎকালীন তত্ববোধায়ক সরকার ফখরুদ্দীন আহমেদ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিসহ চৌদ্দদলীয় মহাজোট এবং বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী দলসহ চারদলীয় জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসন জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এই সংসদের অধিবেশন শুরু হয় ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর। এই সংসদে মোট সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৩৪৫। ২০১১ সালে সংসদে এক বিলের মধ্য দিয়ে নারী সংরক্ষিত আসন ৪৫ থেকে ৫০ উন্নীত করা হয়। এই সংসদের সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। এই সংসদের চিফ হুইফ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন খালেদা জিয়া। সংসদে অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল হামিদ স্পিকার ও শওকত আলী ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পিকার ও শওকত আলী ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। এরআগে শওকত আলী ভারপ্রাপ্ত স্পিকারের দায়ত্বি পালন করেন।
সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন, ১৯৭২-এর মূলনীতি পূনর্বহাল, তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, ১/১১ পরবর্তী দ্বিতীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার নিয়ম বহির্ভুতভাবে ৯০ দিনের অধিক ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি প্রমার্জ্জনা, নারীদের জন্য সংসদে ৫০ টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। ২০১১ সালের ৩ জুলাই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ৪৫ হতে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়েছে।
৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও সতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে। এছাড়াও নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বির্তকের সৃষ্টি হয়। এ নির্বাচনটি নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই বর্জন করে। আর এই এই নির্বাচনে ২৩২টি আসন পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়মী লীগ জয়লাভ করে। এই সংসদে মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৫০ জন। শেখ হাসিনা সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়। এই সংসদের চিফ হুইফ এএসএম ফিরোজ। আর এই সংসদের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন রওশন এরশাদ। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পিকার ও শওকত আলী ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। বিগত সময়ে সংসদের প্রয়োজনে সংবিধানের বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে। দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। সারাদেশে বইছে এখন নির্বাচনের হাওয়া। আর এই একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রত্যাশও যেমন আছে, ঠিক তেমনি অপ্রত্যাশাও আছে। কারণ দেশের মানুষের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত চান না।
মন্তব্যঃ সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ 18826 বার।