প্রাথমিক শিক্ষা হোক মানব উন্নয়নের মূলভিত্তি
অধ্যাপক আনোয়ারুল হক | ০১:৫৯ মিঃ, জুলাই ২১, ২০১৮
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। একটি দেশের ভুখন্ড তার ভৌগলিক সীমানা আর মানুষ সেই সীমানার গর্বিত পাহাড়ারত সৈনিক। ভুখন্ড অর্জন করা যেমন কঠিন তার চেয়েও বেশী কঠিন সেটি গর্বের সঙ্গে রক্ষা করা। সেকারনেই স্বাধীন দেশের পাহাড়ারত সৈনিকদের মানবিক উন্নয়ন সর্বাগ্রে। একটি দেশকে তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত রক্ষা করত: বিশ্বে মাথা উচুঁ করে টিকে থাকতে সেই দেশের প্রতিটি মানুষকে মানবিক মূল্যবোধসহ নৈতিকতা, সামাজিকতা ও পারিপার্শিক বৈশ্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা অত্যাবশ্যকীয়। মানুষ তার শিক্ষা পরিক্রমা শুরু করে শিশুকালে বিদ্যাপাঠের মধ্যদিয়ে। আমাদের দেশে ৪ থেকে ৬ বছর বয়সে একটি শিশু বিদ্যালয়ে যায়। এই শিশুটি বিদ্যালয়ে যায় কচি মন ও মেধা নিয়ে। সেই কচি মন ও মেধাকে যেভাবে গঠন করা হয় সেভাবেই শিশুটির অন্তরীন শক্তিসহ চিন্তা-চেতনামানসিকতা তথা বিশ্বনেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উদ্দীপ্ত শক্তিসমেত গড়ে ওঠা হয়। শিশু মানুষটিকে বৈশ্বিক মর্যাদায় তৈরী করতে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে প্রশ্ন থাকে কেমন হওয়া চাই সেই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কাঠামো। মানুষকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয়। বৃক্ষ যেমনি মাট জলে পরিচর্যায় সবুজে ফুলে ও ফলে বিকশিত হয়ে ওঠে তেমনি মানুষও যদি তার বেড়ে ওঠার প্রাথমিক ভিত্তি মজবুত হয়। শিশু মানবের বড় হয়ে ওঠার দৃঢ় ভিত্তি তার প্রাথমিক শিক্ষা। সেজন্যে বলা হয়ে থাকে, একজন মানুষের সারাজীবনের অর্জিত শিক্ষার ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত হলে মানুষের মানবীয় গুণাবলির উৎকর্ষ সাধিত হয়, তার পরের স্তরের শিক্ষার ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গঠিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে শিক্ষাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সংবিধানের ১৫ (ক), ১৭ এবং ২৮ (৩) নং আর্টিকেলে বাংলাদেশের নাগরিকদের শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়য়িত্বসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায়, বাংলাদেশ সরকার সে সময়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সমাজ গঠনমূলক একটি সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ খুদাকে সভাপতি করে শিক্ষা কমিশন গঠনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় যা ১৯৭৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট নামে প্রকাশিত হয়। এটি পরবর্তীকালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নামানুসারে ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট নাম রাখা হয়। এই কমিশনে প্রাথমিক শিক্ষাকে ১৯৭৬ সাল থেকে ক্রমধারা সময় ১৯৮৩ সালের মধ্যে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয় যদিও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের কারণে তা পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হতে পারেনি। এছাড়াও, ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতির আলোকে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ হিসেবে ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে Primary School Ordinance এবং ১৯৭৪ সালে Primary Education Taking Over অপঃ-এর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে দেশের ৩৬,৬৬৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কর্মরত সকল শিক্ষক এবং স্কুলের যাবতীয় সম্পদ সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে এবং এই পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়। পরবর্তী সময়ে একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় এবং প্রায় প্রত্যেকটি কমিশন রির্পোটে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হলেও সে সময়ে তা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথম (১৯৭৩-৭৮) এবং দ্বিতীয় সময় (১৯৮০-৮৫) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশের ৮টি অঞ্চলে ৪৪টি থানায় international Development Agency (ওউঅ)-এর অধীনে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা (Universal Primary Education) প্রবর্তিত হয়। এছাড়া প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার (Nonformal Education) জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গৃহীত হয়, যেমন গণবিদ্যালয়, সাক্ষরতা বিদ্যালয়, ফিডার স্কুল (Feeder School) যা প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রসরকল্পে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এছাড়া, বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্বতীকালীন দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনায় ও (১৯৭৮-৮০) অপরিবর্তিত ছিল। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণের সময়ে প্রাথমিক শিক্ষার সফল উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরও প্রতিষ্ঠিত হয়।পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে একটি আইন প্রণয়ন করা হয় যা ‘প্রাথমিক শিক্ষা আইন-১৯৮১ নামে পরিচিত। এই আইনের অধীনে মহকুমা পর্যায়ে স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (Local Education Authority) গঠন করা হয় এবং প্রাথমিক শিক্ষার পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন ও তত্তবধান স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত করা হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত ঃ আইনটি বাস্তবায়নের পূর্বেই বাতিল হয়ে যায়। ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও বিকেন্দ্রীকরণ অর্ডিন্যান্স জারির ফলে ১৯৮৩ সালে মহকুমা বিলোপ করে থানাকে উপজেলা পর্যায়ে উন্নীত করা হয় এবং উপজেলা প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালায়ে প্রশাসনিক আদেশ বলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উপজেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত হয়। তখন উপজেলা প্রশাসনের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে প্রেরণ করা হয়। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারীকৃত ১৯৮৬ সালে Standing Orders on Distribution of Work, Organogram, Delegation of Financial and Administrative Powers and Authorities of the Education Division আইন প্রাথমিক শিক্ষার অনেক ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও এ আইনে চাকরি নিয়োগ বিধি, শৃঙ্খলা বিধি, ছুটি, বদলি, পদোন্নতি, অবসর গ্রহণ ইত্যাদি সংক্রান্ত আইন-কানুন ও বিধি-বিধানও রয়েছে। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে (১৯৮৫-৯০) IDA এর অধীনে Universal Primary Education প্রকল্প চালু থাকার সাথে সাথে দেশব্যাপী সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয় প্রকল্প চালু হয়। সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে সমন্বিত স্কুল উন্নয়ন নামে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনা অনুসারে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলির সার্বিক উন্নতি বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এই পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প‘ Second Primary Education Project (SPEP) বাস্তবায়ন করা হয়। এটি ছিল সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে একমাত্র সরকারি প্রজেক্ট যা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পরিচালনা করে। এই প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার ও ৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থা IDA, UNICEF, CIDA Ges UNDP-এর যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়। এর মাধ্যমে স্কুলে ছাত্রছাত্রীর ভর্তি হার বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করার সহায়ক কর্মসূচি হিসেবে SMC (School Managing Committee), PTA, UEC (Upazzila Education Commission) গঠন এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও কার্যকর করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও সিলেবাসের নবায়ন ও উন্নয়ন করা হয় এবং সকল শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হয়। এ সময় ৪টি পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার কাজ পরিচালিত হতো। এগুলো হল- শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, উপজেলা পরিষদ এবং স্কুল ম্যানেজিং কমিটি।
মন্তব্যঃ সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ 35455 বার।