নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ

নাজনীন নাহার | ০৩:৩০ মিঃ, জুলাই ২২, ২০১৮



“নারী” -ছোট্ট একটি শব্দ অথচ একজন মানুষের জন্ম থেকে বেড়ে উঠা , মমতায়, ভালোবাসায় , নিভর্রতায় , কন্যা ,জায়া আর জননীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আজ সহকর্মী, পেশাজীবি কিংবা ব্যবসায়ী। তবে বহুযুগ ধরে নারীর পরিচয় ছিল অন্তপুরে, নিজের কাছে নিজেই ছিল অচেনা। এই অন্তপুরবাসীদের নারীর জীবন পথ-হাটতে আর নিজেকে চিনতে প্রয়োজন ছিল শিক্ষা আর এটা উপলদ্বি করে হাত বাড়িঁয়ে এগিয়ে এসেছিলেন আর এক নারী ”বেগম রোকেয়া”। মেয়রা আজ তাই আর অবরোধ বাসীনি নয়, নয় কেবল দূর্গেশনন্দীনি তারা আজ অবনী হতে আকাশ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছে মহাকাশে। তাই বলে কি বলতে পারি, নারী তুমি আজ তুমি কিংবা সকল অধিকার হয়ে গেছে অর্জন বা তুমি আজ মানুষ হিসাবে মানুষের সকল অধিকারে সমান অধিকারী? তোমার ক্ষমতায়নে পিছিয়ে নেই তুমি। গৃহ নেতৃত্বে আছো না গৃহ কর্মে? সহকর্মী না অধিনস্ত? নীতি নির্ধারনী নাকি নীতি মেনে চলা? সিদ্বান্ত গ্রহনের যে অধিকার তার বাস্তবায়ন বা মতামত প্রদানের যে স্বাধীনতা অথবা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তার কতটুকু অর্জিত? যতটা আজ এগিয়েছে নারী তার চেয়ে বেশী এগুবার যোগ্যতা রাখে আজকের নারী, যোগ্যতা রাখে সঠিক ক্ষমতায়নে । তাহলে সমস্যা কোথায়? আচ্ছা অজর্ন গুলোই কি জানি বা ক্ষমতায়ন ?

ক্ষমতায়ন কি?

ক্ষমতায়ন বলতে সাধারনত সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতা,অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রনকে বোঝায়।নারীর ক্ষমতায়নকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনথ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের  মূল ধারায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। এর পূর্ণ ব্যাখ্যায় বলা যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন, অভিগম্যতা, নিয়ন্ত্রণ এবং সমতার ভিত্তিতে সুফল ভোগে নারীর পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সামাজিক ক্ষমতায়ন বলতে নারীর অধিকার ভোগের বিষয়টি প্রথমে আসে। সমাজে নারী কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সে ভূমিকা পালনে তার ক্ষমতার চর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি বোঝায়। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হলো রাজনীতি চর্চায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। ভোট প্রদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক দলে সমতার জায়গা অর্জন কতটুকু নিশ্চিত তা বোঝায়। এসব জায়গায় নারী বৈষম্যের শিকার বলে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন একই অর্থে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেজন্য ক্ষমতায়নের ধারণা পুরুষের জন্য এক রকম, নারীর জন্য অন্য রকম। নারীর ক্ষমতায়ন সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রধান দিক।

নারীর ক্ষমতায়ন ও বর্তমান বাংলাদেশ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু নারীর অগ্রযাত্রাকে স্থায়ী রূপ দিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা অন্তর্ভুক্ত করেন। নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সংসদে নারীর জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণ করেন। আওয়ামী লীগ সরকার নারী আসন সংখ্যা ৫০এ উন্নীত করেছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৭০ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন, যা মোট সদস্যের শতকরা ২০ ভাগ। এক সম্মেলনে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বলেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক বিশ্বে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সংসদ নেতা ও সরকার প্রধান একজন নারী। সংসদ উপনেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা নারী। সংসদের স্পীকারও এক জন নারী। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ ৬ জন নারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। স্থানীয় সরকারেও প্রায়১৪ হাজার ২শ’ নারী নির্বাচিত হয়েছে জনসেবা করছেন। এই অর্জন অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে। নারী উন্নয়নে নীতি প্রণীত হয়েছে। এর আওতায় বিভিন্ন সংস্থা নারী উন্নয়নে কেন্দ্রিক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। বাজেট বরাদ্দের শতকরা প্রায় ২৮ ভাগ নারী উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে। মাতৃকালীন ছুটি বাড়িয়েছে ৬ মাস করা হয়েছে।’শুধু দেশে নয় সারাবিশ্ব এখন নারীদের ক্ষমতায়নের সুফল ভোগ করছে। অনেক নারী এখন বিশ্ব-নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও মালালা, অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, হিলারি ক্লিনটন, মিশেল ওবামা, সোনিয়া গান্ধী, অং সান সুচি, ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ, দিলমা রুসেফ, অফরাহ উইনফে, শেরি স্যান্ডবার্গ ও ইন্দ্রা নুয়ি ছাড়া আরও অনেক প্রভাবশালী নারীর কথা বলা যায়। আবার ’৪৭-পরবর্তী সময়ে বাংলার নারী-জাগরণের সূচনায় যাঁদের অনবদ্য অবদান সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতে হয় তাঁদের মধ্যে সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগম প্রমুখ উলেখযোগ্য। তাঁরা সম-অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে এনজিওভিত্তিক নারী-আন্দোলনের বিশাল ক্ষেত্র উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব-নেত্রীবর্গের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, রানি ভিক্টোরিয়া, জোয়ান অব আর্ক, অ্যান ফ্রাংক, মার্গারেট থ্যাচারসহ আরও অনেকের কথা বলা যায়। আর্থিক সমৃদ্ধায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নারীদের কী ভূমিকা তা অনুধাবনের জন্য অমর্ত্য সেনের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। অর্মত্য সেনের মতে, নানা আর্থসামাজিক ও রাজনীতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের পক্ষে অভাবনীয় আর্থিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে মূলত নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির জন্য। ‘অ্যান আনসার্টেন গোরি, ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশন্স’(২০১৩) প্রবন্ধে অমর্ত্য সেন বলেছেন, “বাংলাদেশের বেগবান নারীআন্দোলন, সক্রিয় এনজিও-কার্যক্রম ও বেইজিং-পরবর্তী বিশ্ব-নারী-উন্নয়ন এজেন্ডার প্রভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর কৌশলের লক্ষ্যে যে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে, তার মাধ্যমে বাংলার নারীজীবনে এক নীরব বিপবের সূচনা ঘটে, যাকে বিশ্বব্যাংক আখ্যা দিয়েছে ‘হুইসপারটু ভয়েসেস’ (২০০৮)। দেশে বিভিন্ন স্তরে নারী ক্ষমতায় বেড়েছে যা উল্লেখযোগ্য।

 অর্থনৈতিক:

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম পর্যায় ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণের চেষ্টা বা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। আশির দশকে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা চরম দারিদ্র্য মোকাবিলা করে উপার্জনের পথ খুঁজে পায়। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক ও অন্যান্য এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে উলেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ২৬ মিলিয়নের মতো দরিদ্র মানুষ উন্নয়নের পথ খুঁজে পায়।৩৪ এ ঋণগ্রহীতাদের ৯৭ শতাংশের অধিক নারী, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাসের বার্ষিক হার ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূর করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ সব দেশকে পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের আর্থিক সমৃদ্ধিতে জাতি বহুলাংশে নারীদের কাছে ঋণী।আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতিতে নারীদের ভূমিকা রয়েছে। আমরা সরকারি কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করছি, যেখানে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা নারীদের নির্দেশনায় বহু প্রকল্পও আরম্ভ করেছি। আমাদের অবকাঠামো, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা কার্যক্রমের উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা রয়েছে, এমনকি আমাদের সামরিক বাহিনীতেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে, পোশাকশিল্পে নারীদের অবদান অপরিসীম।

সামাজিক:

আমরা আমাদের সমাজকে ক্ষমতায়ন করেছি, আর এ সমাজের মাধ্যমে নারীরাও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশে নারী শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ও উন্নয়নে হয়েছে। নারী শিক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে নারী উন্নয়নে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। তাদের জীবন মানের উন্নয়নে হয়েছে। তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। নারীরা এখন অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল। নারীরা এখন অর্থনীতিসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারছে। কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখতে পারছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছেছে। বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এর গতি অত্যন্ত মন্থর। বর্তমান সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাতায় প্রায় ৩৩ লাখ দরিদ্র, দুস্থ, বিধবা ও বয়স্ক নারীকে মাসিক ভাতা দেয়া হচ্ছে। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ২ লাখেরও বেশি দরিদ্র গর্ভবতী মা ও কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাকে মাসিক ভাতা দেয়া হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের সমাজের অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। দুস্থ মহিলাদের আত্ম- কর্মসংস্থানের জন্য ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। দেশের ৯ লাখ ২০ হাজার নারীকেযে এই কর্মসূচীর আওতাতায় আনা হয়েছেছে। নারী দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে।

রাজনৈতিক:

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক বিশ্বে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সংসদ নেতা ও সরকার প্রধান একজন নারী। সংসদ উপনেতা ও বিরোধীদলীয় নেতা নারী। সংসদের স্পীকারও এক জন নারী। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ ৬ জন নারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। স্থানীয় সরকারেও প্রায়১৪ হাজার ২শ নারী নির্বাচিত হয়েছে জনসেবা করছেন। এই অর্জন অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে। বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ব্যাংক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও নারী পুলিশরাশান্তিরক্ষী হিসেবে অবদান রাখছেন। সরকারী চাকরিতেনারীর জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকনিয়োগে শতকরা ৬০ ভাগ নারী কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধকতা

এতদ উন্নয়ন সত্বেও নারীর ক্ষমতায়ন আশানুরুপ নয় কেননা দেশের ৫০% এর অধিক জনসংখ্যাই নারী , তাদের মধ্যে সামান্য সখ্যংক নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র দিয়ে পুরো গোষ্ঠীকে বিচার করা যাবে না। এগুতে হবে বহুদূর। এ ক্ষমতায় অর্জনে এখও রয়েছে প্রতিবন্ধকতা এর মাঝে উলেখযোগ্য হলো

১. প্রচলিত মূল্যবোধ ও আইনের সীমাবদ্বতা ২.পশ্চাৎপদ রক্ষনশীল ধমার্ন্ধ মানসিকতা।

১. প্রচলিত মূল্যবোধ ও আইনের সীমাবদ্বতা:

 ক. প্রচলিত মূল্যবোধ ও আইনের সীমাবদ্ধতা : সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ নারীকে পুরুষের অধিনেস্ত করে রাখে। শিশুবয়স থেকেই নারী দেখে সমাজে পুরুষদের প্রভাব। শিশুকাল থেকেই সে আচার-আচরণ, পোশাক, চলাফেরা ও কথা বলার ধরন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্নধর্মী নিয়মের জালে আবদ্ধ হয়ে যায়। পিতৃতন্ত্রের পক্ষে এমন সব মূল্যবোধ তৈরি হয় যা নারীকে ছুড়ে ফেলে দেয় অন্ধকার আবর্তে। নারী শিক্ষার সুযোগ পায় না, স্বাবলম্বী হতে পারে না; সর্বোপরি আর্থিক বা মানসিকভাবে তাকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়।

প্রচলিত আইনও নারীর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। সংবিধানে নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ হচ্ছে না। যৌতুক, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি অপরাধে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় অপরাধী। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিয়ে, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব- সব ক্ষেত্রেই আইনের কাঠামোগত দুর্বলতায় নারী হয় বঞ্চিত। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে যে সন্তানকে সে জন্ম দেয়, বড় করে, সে সন্তানের অভিভাবকত্ব পায় না নারী। সম্প্রতি বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নামের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। সম্পত্তির ক্ষেত্রে মুসলিম আইনে নারী পুরুষের অর্ধেক পায়, হিন্দু নারীরা কিছুই পায় না।

খ. পশ্চাৎপদ রক্ষণশীল ধর্মান্ধ মানসিকতা : সমাজে রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন কিছু লোক নারীকে সর্বক্ষেত্রে অবদমিত করে রাখতে চায়। নারীমুক্তিকে তারা ধর্মের চরম অবমাননা বলে ভাবে। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নিয়মের জালে তারা নারীসমাজকে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। আজও গ্রামবাংলার বহু নারী রক্ষণশীল ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন কিছু লোকের ফতোয়ার শিকার। এটি নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।

এছাড়াও প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীকে সবসময় পুরুষের অধস্তন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞাপন চিত্রে অহেতুক নারীর উপস্থিতি টেনে আনা হয়। চলচ্চিত্র কিংবা নাটনে নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন শাড়ি কিংবা গয়না ছাড়া নারীদের আর কিছুই চাইবার নেই। গণমাধ্যমে নারীকে হীনভাবে উপস্থাপন করার জন্যে নারীরাও অনেকাংশে দায়ী।

সমাধানের উপায়

বর্তমান সরকার নারী বান্বব, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে সমাধানের পথে।ক্ষমতায়নকে মানবিক অভিধায় ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। শিক্ষা, মূল্যবোধ, সততা, নৈতিকতা, সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহ্যকে বিবেচনায় না এনে কোনো প্রক্রিয়াতেই নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। আধিপত্যশীল সংস্কৃতির বিদ্যমান অবস্থার সঙ্গে সংঘর্ষ না বাধিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন লাভের জন্য আগে নিজেকে সচেতন হতে হবে। ক্ষমতায়ন লাভের যে পূর্বশর্তগুলো সেগুলো অর্জন করতে হবে। যারা ক্ষমতায়ন লাভ করবে তাদের সচেতনতার পাশাপাশি সমাজে যারা চিন্তাশীল মানুষ আছেন, যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন তাদেরও সচেতন হতে হবে। সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নারী সমাজের জীবনের বাস্তব দিকগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে তার অবস্থান কোথায় তা তাকে উপলব্ধি করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাঠামোগত সংস্কার হয়নি। তথাপি বাংলাদেশের নারীরা থেকে থাকেনি। হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে তারা এগিয়েছে অনেকদূর। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মোটেই কাম্য নয়। নানা বাধা বিপত্তি উতরিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ক্ষমতায়ন লাভের যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দেশের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। সম্মিলিতভাবে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্ব অঙ্গনে নারীর ভূমিকা বাড়াতে হবে। এরকম পরিবেশ দিতে পারলে, আমি বিশ্বাস করি যে, নারীরা সবকিছুই করতে সক্ষম হবে। এটা অলৌকিক কিছু নয়- এটাই বাস্তবতা। নারীরা সাধারণত কাজকর্ম ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রফেশনাল, তাই কোনো কাজে তারা যত আন্তরিক পুরুষেরা তত আন্তরিক হতে পারে না। তাদের এ অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

ক. নারীর স্বার্থ রক্ষাকারী আইন প্রবর্তন : বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তান ধারণে পূর্ণ স্বাধীনতা, সম্পত্তিতে সম অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রভৃতি বিষয়ে সনাতন আইন পালটে নারী-পুরুষের সমান স্বার্থ রক্ষাকারী আইন প্রবর্তন করতে হবে।

খ. শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ: নারীকে নিজ নিজ অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্যে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নারীকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী সতামতের প্রাধান্য দিতে হবে।

গ. প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীকে সম্মানজনকভাবে উপস্থাপন: প্রচার মাধ্যমে নারীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা চলবে না। যথাযোগ্য সম্মানের সাথে এবং রুচিসম্মতভাবেই গণমাধ্যমগুলোতে আসবে নারী চরিত্র।

ঘ. নারীর কাজের স্বীকৃতি : নারীকে তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। সন্তান লালন ও গৃহস্থালি কাজকে কিছুতেই ছোট করে দেখা চলবে না। বরং পুরুষকেও এসব কাজে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে যাতে নারী-পুরুষ উভয়ই ঘরে-বাইরে সমানভাবে কাজে অংশ নিতে পারে।

ঙ. রক্ষণশীল মানসিকতার পরিবর্তন : ধর্মকে পুঁজি করে রক্ষণশীলদের যে ফতোয়াবাজি তা বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। পরিশেষে বলব নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সময় এসেছে নারীকে আরও এগিয়ে নেওয়ার। এ বিষয়টা মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে। কেউ যদি মনে করেন নারীকে অবহেলিত রেখেই সমাজের ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব- সেটা কখনও চিন্তা করাও উচিত হবে না। কারণ পুরুষের সাফল্যের পেছনেও রয়েছে নারীর অবদান। তাই এই নারীসমাজকে এখন আর পেছনে থেকে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজে না লাগিয়ে তাদেরকেও সামনের দিকে নিয়ে এসে সরাসরি কাজে লাগাতে হবে। সম্মানের আসনে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। কোনো নারী যাতে নির্যাতিত না হয়- সেটা দেখতে হবে। নারীর সহযোগিতা ছাড়া কোনো জাতি যোগ্য নাগরিক পায় না। তাই নারীর ক্ষমতায়ন মানেই জাতির ক্ষমতায়ন।এঙ্গোলস তাঁর ‘অরিজিন অব দ্যা ফ্যামিলি’ গ্রন্থে বলেছেন, “নারী মুক্তি তখনই সম্ভব যখন নারীরা সমাজের প্রতিটি কমংকা-সমগুরুত্ব নিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।” আর নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে, নারীর উন্নয়নের জন্যে, এক একথায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে দরকার সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার অবসান। প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। নারী স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মতামত প্রদানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে নারীর ক্ষমতায়নে আর কোনো অপশক্তিই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

মন্তব্যঃ সংবাদটি পঠিত হয়েছেঃ 24833 বার।





এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

০৯:১০ মিঃ, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২০

ইউএনও ওয়াহিদার অবস্থা সংকটাপন্ন

সর্বশেষ আপডেট

মিথ্যাচার বিএনপির একমাত্র সম্বল : ওবায়দুল কাদের প্রস্তাবিত বাজেট সার্বিকভাবে গ্রামীণবান্ধব : পরিকল্পনামন্ত্রী ভারতের ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর সাথে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র এবং মানব সম্পদ মন্ত্রীর বৈঠক দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম রোমানিয়ায় রাজা তৃতীয় চার্লস যারা থাকছেন এরদোগানের শপথ অনুষ্ঠানে প্রস্তাবিত বাজেট দেশের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার বাজেট : হানিফ অজাতশত্রু আফছারুল আমীনের মৃত্যু দলের জন্য ক্ষতি: হাছান মাহমুদ ইউক্রেনে রাশিয়ার জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী পুতিন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আলোচনা প্রত্যাখান দুর্ভাগ্যজনক : মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নেত্রকোনা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুন্নেছা আশরাফের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক এরদোগানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তুরস্ক গেলেন রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার হাসিনা ও এরদোয়ানের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থনীতি প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে : স্পিকার শিশু কল্যাণ বোর্ড শিশুদের উন্নয়নে কাজ করবে : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সামরিক জোটের আধুনিকায়নে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান লাতিন আমেরিকায় ডলার বাদ দিয়ে অভিন্ন মুদ্রা চালুর প্রস্তাব মার্কিন ভিসা নীতির পরও বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি : তথ্যমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে ফারুকের ভূমিকা অবিস্মরণীয় : প্রধানমন্ত্রী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান শপথ নেবেন ৩ জুন